
বিপিএলের নাম শুনলেই একসময় চোখের সামনে ভাসত মিরপুরের স্লো উইকেট, লো-স্কোরিং ম্যাচ আর ব্যাটারদের ধুঁকে ধুঁকে রান তোলার দৃশ্য। কিন্তু ২০২৫ সাল সেই পুরনো চিত্রনাট্য পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। এবারের আসর যেন ব্যাটারদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল, যেখানে বোলাররা ছিলেন অসহায় আর ফিল্ডাররা ব্যস্ত ছিলেন শুধুই বল কুড়াতে। চোখের পলক ফেলার আগেই বল আছড়ে পড়েছে গ্যালারিতে।
এই রান উৎসবের কেন্দ্রে ছিলেন এমন পাঁচজন ব্যাটার, যারা কেবল রানই করেননি, বরং ম্যাচের গতিপথ নিজেদের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করেছেন। নিছক রানের সংখ্যা দিয়ে নয়, বরং তাদের খেলার ধরন আর কৌশলই তাদের বাকিদের চেয়ে আলাদা করেছে। খুনে ব্যাটিং থেকে শুরু করে ক্লাসিক ও নান্দনিক শট, আসুন দেখে নেওয়া যাক বিপিএল ২০২৫-এর সেরা পাঁচ রান সংগ্রাহক কীভাবে টুর্নামেন্ট শাসন করলেন।
মোহাম্মদ নাঈম: ধারাবাহিকতার সঙ্গে পাওয়ারপ্লের ধ্বংসলীলা

৫১১ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়ে মোহাম্মদ নাঈম শুধু পরিসংখ্যানই বাড়াননি, বরং বাংলাদেশি ওপেনারদের খেলার ধরনটাই বদলে দিয়েছেন। আগের আসরগুলোতে দেশি ওপেনারদের বিরুদ্ধে ডট বল খেলার অভিযোগ থাকলেও, এবার নাঈম ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজে। স্থিতিশীলতা আর আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের এক দারুণ ভারসাম্য দেখিয়েছেন তিনি।
তার ৪২.৫৮ গড় নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়, কিন্তু আসল পার্থক্য গড়ে দিয়েছে তার ১৪৩.৬+ স্ট্রাইক রেট। উইকেটে সেট হয়ে ইনিংসকে ১১১ রানে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি কেবল ৩০-৪০ রানের ছোট ক্যামিও খেলতে আসেননি। নতুন বলের সুইং সামলে বোলারদের ওপর চড়াও হওয়ার এই ক্ষমতাই তাকে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ‘কমপ্লিট ব্যাটার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
তানজিদ হাসান: দেশি পেশিশক্তির নতুন বিজ্ঞাপন ও ছক্কার রেকর্ড

নাঈম যদি হন দলের ইঞ্জিন, তবে তানজিদ হাসান ছিলেন টার্বোচার্জার। ৪৮৫ রান নিয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করা তানজিদের বিশেষত্ব ছিল তার বিধ্বংসী রূপ। তিনি কেবল বাউন্ডারি মারেননি, বলকে স্টেডিয়ামের বাইরে পাঠিয়েছেন অবলীলায়। এক আসরে ৩৬টি ছক্কা হাঁকিয়ে বাংলাদেশি হিসেবে বিপিএলে নতুন রেকর্ড গড়েছেন তিনি।
তানজিদ যেন ভয়ডরহীন ক্রিকেটের নতুন প্রতীক। যখন অন্য ব্যাটাররা এক-দুই রানের জন্য খেলছিলেন, তানজিদের চোখ ছিল শুধুই গ্যালারিতে। তার ১০৮ রানের ইনিংসটি ছিল আধুনিক টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের মাস্টারক্লাস। তিনি প্রমাণ করেছেন, বল ওড়ানোর জন্য বিদেশি হতে হয় না, দেশি ব্যাটারের কব্জির জোরই যথেষ্ট। বোলারদের মনে আতঙ্ক ছড়াতেই তিনি ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা।
গ্রাহাম ক্লার্ক: গড়ের চেয়ে গতিই যার কাছে আসল

চট্টগ্রাম কিংসের ব্যাটিং লাইনআপে অ্যাড্রেনালিন শটের কাজ করেছেন গ্রাহাম ক্লার্ক। সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক বিদেশি ব্যাটার (৪৩১ রান) হিসেবে ক্লার্ক নিজেকে আলাদা করেছেন গতির ঝড়ে। তার গড় ৩০.৭৮ সতীর্থদের চেয়ে কিছুটা কম মনে হতে পারে, কিন্তু সেরা পাঁচের মধ্যে তার স্ট্রাইক রেটই ছিল সর্বোচ্চ (১৫৩.৩৮) ।
ক্লার্কের ভূমিকা উইকেট বাঁচানো ছিল না, বরং ম্যাচের শুরুতেই প্রতিপক্ষকে দুমড়েমুচড়ে দেওয়া। যারা Sportslivehub-এ লাইভ স্ট্রিমিং দেখেছেন, তারা লক্ষ্য করেছেন যে ক্লার্কের দর্শন ছিল সোজা “বল দেখো, আর ওড়াও।” পাওয়ারপ্লেতে তার এই খুনে মেজাজ অনেক ম্যাচকে প্রথম ছয় ওভারেই শেষ করে দিয়েছে। দলের প্রয়োজনে নিজের গড়ের তোয়াক্কা না করে দ্রুত রান তোলাই তাকে বিশেষত্ব দিয়েছে।
তামিম ইকবাল: চার-ছক্কার ঝড়েও ‘ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট’

চারপাশে যখন ছক্কার বৃষ্টি, তখন তামিম ইকবাল প্রমাণ করলেন—”ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট।” ফরচুন বরিশালের এই অভিজ্ঞ সেনানী ৪১৩ রান করেছেন অন্ধের মতো ব্যাট না চালিয়েই। বরং গ্যাপ খুঁজে বাউন্ডারি বের করার শিল্পে তিনি ছিলেন অনন্য। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৫১টি চার মেরে তিনি দেখিয়েছেন, শক্তির চেয়ে টাইমিং কত বেশি কার্যকরী হতে পারে।
ক্লার্কের তুলনায় তামিমের ১২৯.০৬ স্ট্রাইক রেট কম মনে হতে পারে, কিন্তু দলের ‘অ্যাঙ্কর’ হিসেবে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি এক প্রান্ত আগলে রাখায় অন্য প্রান্তের ব্যাটাররা নির্ভার হয়ে খেলতে পেরেছেন। অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে ইগোর লড়াইয়ে না গিয়ে, দলের ভিত শক্ত রাখার কৌশলেই তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা।
এনামুল হক বিজয়: দলের বিপর্যয়ে আস্থার খুঁটি

সেরা পাঁচের তালিকা পূর্ণ করা এনামুল হক (৩৯২ রান) ছিলেন দুর্বার রাজশাহীর ভরসার স্থল। তামিমের মতোই এনামুল তাড়াহুড়ো না করে উইকেটে টিকে থাকার দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। তার সেঞ্চুরিটি (১০০) ছিল ধৈর্য এবং ফিটনেসের এক দারুণ প্রদর্শনী। এনামুলের কাজটা ছিল সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন, দলের ‘ব্যাকআপ প্ল্যান’ হিসেবে থাকা। ১৩০.৬৭ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করে তিনি নিশ্চিত করেছেন যেন দ্রুত উইকেট পড়লেও দল ধসে না পড়ে। স্ট্রাইক রোটেট করা এবং বাজে বলকে সীমানা ছাড়া করার মাধ্যমে তিনি তার আগ্রাসী সতীর্থদের জন্য পারফেক্ট পার্টনার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন।
বিপিএল ২০২৫-এর রান চার্ট আমাদের একই মঞ্চে বিভিন্ন ব্যাটিং কৌশলের সফলতার গল্প শোনায়। আমরা দেখেছি তানজিদের র ‘পাওয়ার’, নাঈমের মেপে নেওয়া আগ্রাসন, ক্লার্কের বেপরোয়া গতি এবং অভিজ্ঞদের ঠান্ডা মাথার ব্যাটিং। এই পাঁচজন কেবল ভাগ্যগুণে রান পাননি, তারা দলের প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের ভূমিকা পালন করেছেন। তবে এবারের আসরের সবচেয়ে বড় জয় হলো দেশি ব্যাটারদের বিবর্তন—অবশেষে আমাদের ঘরের ছেলেরা আর ফলোয়ার নয়, বরং লিডার হয়েই ফ্রন্টফুট থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
১. বিপিএল ২০২৫-এ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক কে?
খুলনা টাইগোর্সের মোহাম্মদ নাঈম ১৪ ম্যাচে ৫১১ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছেন।
২. টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি ছক্কা কে মেরেছেন?
ঢাকা ক্যাপিটালসের তানজিদ হাসান টুর্নামেন্টে ৩৬টি ছক্কা মেরে রেকর্ড গড়েছেন।
৩. সবচেয়ে সফল বিদেশি ব্যাটার কে ছিলেন?
চট্টগ্রাম কিংসের গ্রাহাম ক্লার্ক ৪৩১ রান এবং ১৫৩.৩৮ স্ট্রাইক রেট নিয়ে সেরা বিদেশি ব্যাটার ছিলেন।
ডিসক্লেইমার: এই আজকের ট্রেন্ডিং (ব্লগ) কেবল লেখকের ব্যক্তিগত মতামত ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। আলোচিত বিষয়গুলো ভেবে দেখুন, বিশ্লেষণ করুন, আর নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিন।
বিপিএল ২০২৫-এর সেরা ৫ উইকেট শিকারি: এই পাঁচ বোলার যেভাবে গড়েছেন জয়ের ভিত
বিপিএল নিলামে সর্বোচ্চ দরে বিক্রি হওয়া খেলোয়াড়দের তালিকা: এবারের আসরের সবচেয়ে দামি তারকা কারা?
পিএসএল ২০২৬-এর টিকিট বুকিং গাইড: দাম, ভেন্যু ও সিটিং ক্যাটাগরি – সব জেনে নিন এখনই
বিগ ব্যাশ লিগ ২০২৫-এর সর্বোচ্চ বেতনভুক্ত ক্রিকেটাররা: পূর্ণ বেতন তালিকা, শীর্ষ আয়কারী ও দলগুলোর বাজেট

